ছোটদের মজার গল্প: বনের বুদ্ধিমান শিয়াল
শিয়ালের বুদ্ধিমত্তা
এক চতুর প্রাণীর গল্প, যে বুদ্ধি দিয়ে এক বিশাল বিপদকে হার মানালো
অনেক, অনেক বছর আগের কথা। তখন ঘন বনাঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এক ছোট্ট রাজ্য—বনপুর। এই রাজ্যের কোনো রাজা-রানী ছিল না, ছিল না কোনো সৈন্য-সামন্ত, তবু ছিল শৃঙ্খলা আর ভালোবাসা। সব প্রাণী মিলেমিশে একসাথে বসবাস করত।
বনে হাতি ছিল, ছিল গম্ভীর গণ্ডার, ঝাঁপাঝাঁপি করা বানর, মিষ্টি কণ্ঠের পাখি, শান্ত স্বভাবের হরিণ, হাসিখুশি খরগোশ আর, অবশ্যই, এক চতুর শিয়াল।
শিয়ালটির নাম ছিল চতুরচালাক। নামের মতোই সে ছিল চতুর, চিন্তাশীল আর ঠান্ডা মাথার। বনের যেকোনো গোলযোগে সে একেবারে ভেবেচিন্তে উপায় বার করত। তার বন্ধুরা বলত, চতুরচালাকের মাথায় যেন কেবল বুদ্ধির বাতি জ্বলে!
সব কিছু ভালোই চলছিল, প্রাণীরা সুখে-শান্তিতে ছিল। কিন্তু সুখের দিন তো বেশিদিন স্থায়ী হয় না। একদিন সেই শান্ত বনেই এলো এক বিশাল বিপদ।
সিংহের আগমন
একদিন দূর পাহাড়ের দিক থেকে হঠাৎ করে বনে চলে এল এক বিশাল, হিংস্র সিংহ। তার নাম দান্তবাহু। সে শক্তিশালী, ভয়ঙ্কর আর একেবারে ধ্বংসাত্মক স্বভাবের। সে এলেই ঝড় ওঠে, গর্জনে কাঁপে গোটা বন।
প্রথম দিনেই সে এক হরিণ ধরে খেয়ে ফেলল। সবাই চমকে গেল! পরের দিন এক খরগোশ, তৃতীয় দিন এক বানর... দিন পেরোতেই সে একে একে প্রাণীগুলো খেতে লাগল।
প্রাণীরা ভয় পেয়ে এক সভা ডাকল। সবাই জড়ো হলো বনের মাঝখানে। হাতি বলল, এভাবে চলতে থাকলে তো আমরা কেউই বাঁচব না!
বানর বলল, কিছু করতে হবে! না হলে সে একদিন গোটা বন খেয়ে ফেলবে!
চতুরচালাক তখন বলল, আমরা যদি তাকে খুশি রাখতে পারি, হয়তো সে প্রতিদিন একটা প্রাণী খেয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, আর অন্যদের ছাড় দেবে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রাণীরা এতে রাজি হলো। তারা সিদ্ধান্ত নিল—প্রতিদিন পালাক্রমে একজন প্রাণী যাবে সিংহের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করতে। আতঙ্কের দিনগুলো
এই নিয়মে দিন চলতে লাগল। প্রথমে হরিণ গেল, পরের দিন বানর, তারপর খরগোশ, তারপর এক পাখি। কেউ ফিরে এল না। প্রতিদিন কার পালা হবে, সেটা জানার আগেই প্রাণীরা আতঙ্কে থাকত।
বন যেন এক নীরব, দুঃখ ভারাক্রান্ত জায়গায় পরিণত হলো। কেউ হাসে না, কেউ খেলে না। শিশু খরগোশ পর্যন্ত বলত, আম্মা, আজ আমার পালা নয় তো?
চতুরচালাক দুঃখ পেল এই অবস্থায়। সে ভাবল, এভাবে তো চলতে পারে না। কিছু একটা করতেই হবে।
শিয়ালের পালা
একদিন ঘোষণা এলো—আজ শিয়াল চতুরচালাকের
পালা।
সবাই কেঁদে ফেলল। তারা বলল, চতুরচালাক ভাই, তুমি তো আমাদের শেষ ভরসা ছিলে!
শিয়াল কিন্তু একটুও ভয় পেল না। সে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ভয় পেও না। আমি মরতে যাচ্ছি না, বরং দান্তবাহুকে শায়েস্তা করেই ফিরব। শুধু আমার উপর বিশ্বাস রাখো।
সে একটি পরিকল্পনা করল। খাওয়া-দাওয়া করল, গা গুছিয়ে প্রস্তুতি নিল, তারপর রওনা দিল সিংহের গুহার দিকে। কিন্তু সে একেবারে ইচ্ছা করেই দেরি করল।
সিংহের গুহায় সে পৌঁছাল দুপুর পেরিয়ে যাওয়ার পরে। তখন সিংহ ঘুম থেকে উঠে ক্ষুধায় গর্জন করছে।
কে আছে আমার আজকের খাবার?—সিংহ গর্জে উঠল। ঠিক সেই সময় চতুরচালাক এল হাপাতে হাপাতে।
বুদ্ধির খেলা শুরু
সিংহ রেগে বলল, এত দেরি করেছ কেন? তোমায় এখনই খেয়ে ফেলব!
শেয়াল বলল, মহারাজ, শাস্তি দিন, তবুও আগে আমার কথা শুনুন। আজকের দিনটা আমি চাইলে শান্তিতেই কাটাতে পারতাম, কিন্তু পথে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে।
সিংহ বলল, বলো, কী হয়েছে?
শেয়াল বলল, পথে আসার সময় আমাকে আটকায় আরেক সিংহ! সে বলে, এই বন এখন আমার। আমি তোমার মত ছোট প্রাণীদের খাই, আর বড় সিংহকে তাড়িয়ে দিই। আমি বললাম, না না, আমি দান্তবাহু মহারাজের প্রজাদের একজন। তাঁকে খাবার দিতে যাচ্ছি। কিন্তু সে আমাকে ছাড়তে চায়নি!
সিংহ দান্তবাহুর চোখ জ্বলে উঠল, কি বলছো? আমার বনে আরেক সিংহ?
শেয়াল বলল, সে ভয়ঙ্কর ছিল, ঠিক আপনার মতো। বলল, তার গুহা নাকি এই কাছেই। আমি তাকে ফাঁকি দিয়ে কোনোমতে আপনার কাছে আসলাম।
দান্তবাহু গর্জে উঠল, আমাকে দেখাও সেই বেয়াদবকে!
শেয়াল মুচকি হেসে বলল, চলুন তবে। আমি তাকে দেখাতে পারি, কিন্তু আপনি শান্ত থাকতে পারবেন তো?
চলো!—বলল সিংহ।
কুয়োর প্রতিচ্ছবি
শেয়াল সিংহকে নিয়ে গেল এক গভীর কুয়োর কাছে। কুয়োর পানি পরিষ্কার, একেবারে আয়নার মতো। সে বলল, এই গুহার ভেতরে আছে সেই সিংহ। আপনি আগে চুপ করে একবার কুয়োর ভেতর তাকান।
সিংহ নিচে তাকাল আর তাতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। তার মতো আরেক সিংহ তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
সে গর্জন করতেই জলে থাকা প্রতিচ্ছবিও গর্জন করল।
সে ভাবল, আহা! সাহস তো কম নয়। আমায় দেখে গর্জে ওঠে?
রাগে অন্ধ হয়ে সে এক লাফে কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিল।
ঢপাৎ!
সিংহের পা স্লিপ করে গেল, আর সে সোজা পড়ে গেল পানিতে। প্রচণ্ড গর্জনের শব্দ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সে তলিয়ে গেল একেবারে।
প্রাণীদের মুক্তি
চতুরচালাক তখন মুখে বিজয়ীর হাসি নিয়ে চিৎকার করে বলল, বন্ধুরা! আমাদের ভয়ঙ্কর সমস্যা শেষ! দান্তবাহু আর বেঁচে নেই!
গোটা বন হঠাৎ আনন্দে ফেটে পড়ল। সব প্রাণী দৌড়ে এল, শেয়ালকে কাঁধে তুলে নাচতে লাগল।
হাতি বলল, চতুরচালাকই আমাদের রক্ষা করল!
বানর বলল, সে শুধু চতুর না, সে আমাদের নায়ক!
সবাই মিলে তাকে ‘বনপুরের মহাজ্ঞানী উপদেষ্টা
ঘোষণা করল। এখন থেকে বনবাসীরা আর ভয়ে থাকে না। তারা জানে, যেকোনো বিপদে চতুরচালাকই পথ দেখাবে।
শেষমেশ
চতুরচালাক তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিল, শক্তি সব সময় সবকিছু নয়—বুদ্ধি, ধৈর্য, আর সাহস থাকলে হিংস্র প্রাণীকেও হারানো যায়।
বনের প্রতিটি শিশু এখন তাকে দেখে বড় হতে চায়। বনের প্রতিটি স্কুলে শেখানো হয়—চতুরচালাকের গল্প শুনো, বুদ্ধি দিয়ে চলা শিখো।
গল্পের মূল শিক্ষা
*বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
*শত্রুর শক্তি যত বড়ই হোক, বুদ্ধির কাছে হার মানে।
*সত্য সাহসী সেই, যে চিন্তা করে কাজ করে।