মজাদার গল্প
ভাঙা ঘড়ির সময়
রাত তখন সাড়ে তিনটা। শহরের অলিগলিতে কুয়াশা ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাস্তার বাতিগুলো অর্ধঘুমে। অথচ একটি পুরনো ঘড়ির দোকানে তখনও আলো জ্বলছে। দোকানটির মালিক, এক বৃদ্ধ মানুষ — নাম তার আফতাব চাচা।
তাঁর বয়স আশির কোঠায় হলেও চোখে-মুখে অদ্ভুত তেজ। একসময় শহরের বিখ্যাত ঘড়ি মেরামতের কারিগর ছিলেন। এখন আর কেউ ঘড়ি ঠিক করাতে আসে না, সবাই বলে, মোবাইলে সময় থাকে চাচা! তবু তিনি রোজ সকাল ৮টায় দোকান খোলেন, রাত ৯টায় বন্ধ করেন। যেন সময় তার কাছে আজও একটা পবিত্র চুক্তি।একদিন হঠাৎ এক কিশোর ঢুকল দোকানে। পরনে স্কুল ড্রেস, হাতে একটি ভাঙা দেয়াল ঘড়ি।
চাচা, এই ঘড়িটা ঠিক করে দেবেন?আফতাব চাচা অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালেন। তার চোখে ছিল উৎসাহ, শ্রদ্ধা আর একটা শূন্যতা।কার ঘড়ি এটা?
আমার নানুর। উনি নেই আর। কিন্তু আমি চাই ওটা আবার চলুক। আফতাব চাচা ঘড়িটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। পুরনো, ধূলিধূসরিত — তবে ভেতরে এখনো একটা ইচ্ছে কাজ করছে যেন।
আমি ঠিক করে দেব। তবে সময় লাগবে।ছেলেটি হাসল। সময় তো চলেই যায় চাচা, আপনি সময় নিয়ে করুন।
ঘড়িটা রাখতে রাখতে আফতাব চাচার মনে পড়ল সেই সময়ের কথা, যখন তার স্ত্রী হাসনা বেগম তাকে প্রথম উপহার দিয়েছিলেন এক সোনালি ঘড়ি। সেই
ঘড়িটা রাখতে রাখতে আফতাব চাচার মনে পড়ল সেই সময়ের কথা, যখন তার স্ত্রী হাসনা বেগম তাকে প্রথম উপহার দিয়েছিলেন এক সোনালি ঘড়ি। সেই ঘড়ি এখনো তাঁর দোকানের দেয়ালে ঝুলে আছে — থেমে আছে একটাই সময় দেখিয়ে: ১০টা ১৫ মিনিট।
হাসনার মৃত্যুর সময় ঠিক এই সময়েই ঘড়িটা থেমে গিয়েছিল।
তিন দিন পর, ছেলেটি আবার এল।
চাচা, ঘড়ি কি ঠিক হয়েছে?
আফতাব চাচা ঘড়িটা হাতে তুলে আনলেন। এখন সেটি কাঁটার মতো টিকটিক শব্দ করে চলছে।
এটা শুধু সময় দেখায় না, স্মৃতি বয়ে আনে। খুব যত্নে
রেখো।
ছেলেটির চোখে জল। — ধন্যবাদ চাচা।
তাকে বিদায় দিয়ে দোকানের জানালায় দাঁড়িয়ে
আফতাব চাচা দেখলেন রোদ উঠছে, পাখিরা ডাকছে। তিনি ধীরে ধীরে তাঁর স্ত্রীর সেই সোনালি ঘড়িটার দিকে তাকালেন।
হঠাৎ, টিক... টিক... শব্দ শুরু হলো।
ঘড়িটি আবার চলতে শুরু করেছে।
তিনি চমকে গেলেন। এত বছর পর ঘড়ি নিজে থেকে চলছে! না, এটা হয় না। তিনি বুঝলেন, এ শুধু একটা যান্ত্রিক মিরাকল নয়, এ এক উপলব্ধি। হয়তো ভাঙা সময়ের মাঝেই কিছু একটা সত্যি লুকিয়ে থাকে।
তিনি চোখ বুজলেন, মনে মনে হাসনার মুখটি দেখতে পেলেন। মনে হলো, সময় আবার ফিরে এসেছে।