Steps of Time: A Journey to Fulfill Dreams
পর্ব ১ : পাহাড়ের গ্রামের মেয়ে
সিলেটের সীমান্তঘেঁষা এক পাহাড়ি গ্রামে জন্ম নিল নাজমা নামের এক মেয়ে। চারদিকে ছোট ছোট পাহাড়, ঝরনা আর কুয়াশা—প্রতিদিন সকাল মানেই ছিল প্রকৃতির রঙিন ছবি। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের আড়ালে ছিল ভয়াবহ দারিদ্র্য। নাজমার বাবা ছিলেন চা-বাগানের শ্রমিক, মা স্থানীয় হাটে সবজি বিক্রি করতেন। সংসারের আয়ে স্কুলের ফি জোগানো প্রায় অসম্ভব ছিল।
নাজমা ছোটবেলা থেকেই কৌতূহলী ও অধ্যবসায়ী। যখন অন্য বাচ্চারা বিকেলে খেলা করত, তখন সে মায়ের কাছ থেকে পুরনো কাগজ আর ভাঙা পেন্সিল নিয়ে বসত। তার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার, যেন গ্রামে মেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পায়। কিন্তু গ্রামে অনেকেই বলত, মেয়েদের এত পড়াশোনার দরকার কী? বিয়েই তার ভবিষ্যৎ। এই কটূক্তি নাজমাকে তার স্কুল যাওয়ার পথ ছিল চার কিলোমিটার দীর্ঘ। কাঁদাপথ, বৃষ্টির সময় পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তা—তবু নাজমা প্রতিদিন সময়মতো স্কুলে যেত। বৃষ্টির দিনে ভেজা কাপড়ে ক্লাস করা বা পুরনো খাতার ছেঁড়া পাতায় লিখে পরীক্ষা দেওয়া—এসব তার জন্য সাধারণ ঘটনা হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষকরা তার মেধা দেখে বিস্মিত হতেন এবং প্রায়ই বলতেন, এই মেয়েটা যদি সুযোগ পায়, একদিন গ্রাম আর পরিবারকে বদলে দেবে।
কিন্তু ঘরে ফিরে নাজমার অপেক্ষায় থাকত অন্য লড়াই। বিদ্যুতের অভাবে কেরোসিনের লণ্ঠনের আলোয় পড়তে হতো। কখনও জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে চাঁদের আলোই ভরসা ছিল। শীতকালে পাতলা কাপড়ে পড়তে গিয়ে হাত জমে যেত, তবু সে বই বন্ধ করত না। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বলত, আমার স্বপ্ন এই পাহাড়ের চূড়ার মতো উঁচু। যত বাধাই আসুক, আমি একদিন পৌঁছে যাব।
এই দৃঢ়তা ও স্বপ্ন ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি, যা তাকে সময়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সাহস দিত।
পর্ব ২ : শহরের দোরগোড়ায় স্বপ্ন
নাজমা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করল। গ্রামের শিক্ষকরা বললেন, তোমার মতো মেয়েদের জন্য শহরের কলেজ দরকার। কিন্তু শহরে পড়তে গেলে টাকার প্রয়োজন। তার বাবার সামর্থ্য সীমিত—মাস শেষে পরিবার চালাতেই হিমশিম খেতেন।
মেয়ের স্বপ্নের কথা ভেবে বাবা-মা হাটে একটি পুরোনো ছাগল বিক্রি করলেন। গ্রামের কিছু মানুষও টাকা তুললেন। এই সামান্য অর্থে নাজমা ভর্তি হলো শহরের কলেজে। প্রথম দিন কলেজের বিশাল ভবন দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গেল। তবে শহর তার জন্য নতুন ও কঠিন ছিল। এখানে সবাই পরিপাটি পোশাক পরে, দামি বই নিয়ে ক্লাস করে। নাজমার হাতে ছিল পুরোনো ব্যাগ, সেলাই করা ইউনিফর্ম আর ধার করা বই।
মেসে থাকা শুরু করল নাজমা। ভোরে বাসন মাজা, রান্না, কলেজে যাওয়া—তারপর বিকেলে টিউশনি করে নিজের খরচ জোগানো—এই ছিল তার রুটিন। অনেক সময় পেট খালি থাকত। এক সন্ধ্যায় এক সহপাঠী মজা করে বলল, তোমার ব্যাগও তো প্রায় ভেঙে পড়ছে! সে শুধু হাসল। মনে মনে বলল, ব্যাগের ভেতরের স্বপ্নটাই একদিন আমাকে উঁচু করবে।
টিউশনির আয়ে কেনা প্রথম নতুন খাতাটা তার কাছে ছিল এক অনন্য অর্জন। রাতে জানালার বাইরে শহরের আলো দেখে সে লিখল, আজকের কষ্টই আমার আগামীর গর্ব হবে।
শিক্ষকরা তার অধ্যবসায় লক্ষ্য করলেন। এক শিক্ষিকা তাকে অতিরিক্ত নোট দিলেন এবং বললেন, তুমি লড়াই চালিয়ে যাও। তোমার সাফল্য একদিন অনেককে অনুপ্রাণিত করবে। এই কথাগুলো নাজমাকে আরও শক্ত করল।
কলেজ জীবনে সে শিখল—শহরের আড়ম্বরপূর্ণ আলো-ঝলমলে দুনিয়ার আড়ালে অনেক কঠিন সত্য লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সংকল্প আর পরিশ্রম থাকলে, পাহাড়ের গ্রাম থেকে আসা মেয়েও স্বপ্ন ছুঁতে পারে।
পর্ব ৩ : ব্যর্থতা ও নতুন পথের খোঁজ
কলেজের প্রথম বর্ষের শেষ দিকে নাজমার জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠল। পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে তার টিউশনি চলে গেল—যে পরিবারে পড়াত, তারা অন্য জায়গায় চলে গেল। হোস্টেলের ভাড়া বাকি পড়ল, আর খাবারের জন্য পকেটে এক টাকাও নেই। সন্ধ্যায় সে কলেজ মাঠে একা বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ চোখে জল চলে এল।
পরদিন ক্লাসে নাজমা মনোযোগ হারিয়ে ফেলল। তার ফলাফল আগের মতো উজ্জ্বল হল না। শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে নাজমা? সে শুধু হাসল, কিছু বলল না। অন্তরে ভয়—যদি আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারি?
একদিন কলেজের লাইব্রেরিতে একটি পুরোনো বই পেয়ে গেল, যেখানে লেখা ছিল: হাজারো ব্যর্থতা কেবল সাফল্যের পথে সিঁড়ি। এই একটি বাক্য যেন তার ভেতরে নতুন আগুন জ্বালিয়ে দিল।
নাজমা সিদ্ধান্ত নিল, হাল ছাড়বে না। সে কলেজের নোটিশ বোর্ডে খুঁজে খুঁজে নতুন টিউশনি পেল। এবার তাকে আরও দূরের এক বাড়িতে যেতে হতো। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে এক ঘণ্টা হাঁটতে হাঁটতে সেখানে যেত, তারপর পড়িয়ে গভীর রাতে মেসে ফিরত। ক্লান্ত শরীর নিয়েও সে পড়াশোনা চালিয়ে গেল।
একদিন এক সিনিয়র ভাই তার গল্প শুনে বললেন, তুমি চাইলে ডিবেট ক্লাবে যোগ দিতে পারো। তোমার সাহসিকতা দিয়ে অনেককেই অনুপ্রাণিত করবে। নাজমা প্রথমে দ্বিধা করলেও পরে যোগ দিল। ডিবেট ক্লাবে সে নিজের কথা বলতে শিখল—কিভাবে ছোট গ্রাম থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে প্রতিকূলতার মাঝেও স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে।
ডিবেটের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার সময় হাত কাঁপছিল, কণ্ঠ কেঁপে যাচ্ছিল। কিন্তু যখন দেখল, শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে শুনছে, তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিল। বক্তৃতা শেষে করতালিতে পুরো হল ভরে উঠল।
সেই মুহূর্তে নাজমা বুঝল—ব্যর্থতা কখনও শেষ নয়। এটা কেবল পথ বদলের ইঙ্গিত। তার মনে জাগল এক নতুন বিশ্বাস: স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা যতই আসুক, আমি চলব।
পর্ব ৪ : সুযোগের দরজা
ডিবেট ক্লাবের সাফল্যের পর নাজমার নাম কলেজজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। তার স্পষ্ট উচ্চারণ, সাহসী যুক্তি এবং ব্যক্তিত্ব সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। একদিন কলেজের এক শিক্ষক তাকে ডেকে বললেন, নাজমা, জেলা পর্যায়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য তোমাকে মনোনীত করা হয়েছে।
নাজমা প্রথমে ভয় পেয়েছিল। “আমি কি পারব?—মনে এমন প্রশ্ন জাগল। কিন্তু ভেতরের একটি কণ্ঠ বলল, এটাই সেই সুযোগ, যেটার জন্য এতদিন লড়াই করছ। প্রতিযোগিতার আগের রাত সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গ্রাম ও পরিবারের কথা ভাবল। দূরের আকাশে জ্বলজ্বলে তারাগুলো দেখে মনে হলো তারা যেন তাকে সাহস দিচ্ছে।
প্রতিযোগিতার দিন হলে ঢোকার সময় তার হৃদয় দ্রুত ধুকপুক করছিল। দর্শকসারি ভরা, বিচারকরা বসে আছেন গম্ভীর মুখে। প্রথম রাউন্ডেই নাজমার যুক্তি ও স্বচ্ছ ভাষা সবাইকে মুগ্ধ করল। দ্বিতীয় রাউন্ডে যখন কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হল, নাজমা হাসিমুখে আত্মবিশ্বাসী উত্তর দিল। শেষ রাউন্ড শেষে ঘোষক বললেন, জেলার সেরা বিতার্কিক—নাজমা বেগম!
পুরস্কার হিসেবে সে পেল একটি সার্টিফিকেট ও নগদ অর্থ। অর্থের পরিমাণ বড় না হলেও তার জন্য এটা ছিল নতুন দরজা খোলার মতো। এই সাফল্যের খবর গ্রামে পৌঁছালে, গ্রামের মানুষ গর্বে ভরে উঠল। বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছিস।
পুরস্কারের কিছু টাকা দিয়ে নাজমা একটি পুরোনো কিন্তু ভালো মানের ল্যাপটপ কিনল। এখন সে অনলাইনে পড়াশোনা ও নতুন নতুন বিষয় শিখতে পারছিল। কলেজের শিক্ষকরা তাকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও সেমিনারে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। এই সময়েই সে শহরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলো। তারা দরিদ্র শিশুদের জন্য বিনামূল্যে পাঠশালা চালাত। নাজমা সেখানে গিয়ে দেখল, অনেক শিশুর চোখে সেই একই স্বপ্ন, যেটি একসময় তার চোখে ছিল। সে প্রতিজ্ঞা করল, আমি বড় হলে এমন অনেক দরজা খুলে দেব।
এইসব কাজের মাধ্যমে নাজমা শিখল—সুযোগ শুধু নিজের জীবন পাল্টানোর জন্য নয়, অন্যের জীবনেও আলো ছড়ানোর জন্য। তার বিশ্বাস দৃঢ় হল, প্রতিটি কষ্টই একদিন সিঁড়ি হয়ে তাকে আরও উঁচুতে তুলবে।