Dreams Under the Blue Sky
পর্ব ১ : শৈশবের মাটির গন্ধ
দিনাজপুর জেলার মহুয়া নামের একটি ছোট্ট গ্রাম। কাঁচা রাস্তা, চারদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত, ভোরবেলায় কাকডাকা আর পাখির গান—সব মিলিয়ে গ্রামটা যেন শান্তির ঠিকানা। এই গ্রামেই জন্ম নেয় রাহাত নামের এক ছেলেটি। তার বাবা ছিলেন কৃষক, মা গৃহিণী। সংসার চলত অনেক কষ্টে, কখনও ভালো ফসল হলে কিছুটা স্বস্তি, আবার খারাপ মৌসুমে ধার করে সংসার চালাতে হতো।
রাহাত ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম ছিল। সমবয়সীরা মাঠে খেলাধুলায় মেতে থাকলেও সে বই নিয়ে মগ্ন থাকত। তার বই পড়ার আগ্রহ দেখে মা প্রায়ই বলতেন—
আমার এই ছেলে একদিন অনেক দূর যাবে।
কিন্তু বই জোগাড় করা সহজ ছিল না। নতুন বই কেনার সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। ফলে রাহাতকে পড়তে হতো পুরোনো ছেঁড়া বই কিংবা স্কুলের লাইব্রেরি থেকে ধার করা বই।
প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেত সে। অনেক সময় পায়ে জুতো থাকত না। সহপাঠীরা মজা করত, কেউ বলত—গরিবের ছেলে, জুতোও নেই। এসব শুনে কষ্ট পেলেও রাহাত নিরুৎসাহ হতো না। তার মনে হতো, একদিন আমার কষ্ট সব বৃথা যাবে না।
রাতে পড়াশোনার সময় ঘরে বিদ্যুৎ থাকত না। কেরোসিনের ক্ষীণ আলোতে বই পড়ত। শীতকালে গায়ে জড়াতো একটা পাতলা চাদর, তবুও ঘন্টার পর ঘন্টা পড়তে বসে থাকত। কখনও বইয়ের পাতার ওপর ঘুমিয়ে পড়ত, আবার ভোরে উঠে আবার পড়া শুরু করত।
গ্রামের অন্য বাচ্চাদের মতো খেলাধুলা বা উৎসবে তার বেশি আগ্রহ ছিল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে তার
মনে হতো—
একদিন আমি এই গ্রামের সীমা ছাড়িয়ে দূরে যাবো। বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করব। আমার স্বপ্ন হবে নীল আকাশের মতো বড়, অসীম।
এই দৃঢ় সংকল্পই তার শৈশবের সঙ্গী হয়ে গেল।
পর্ব ২ : দারিদ্র্যের দেয়াল
রাহাত যখন মাধ্যমিক স্কুলে উঠল, তখন তার পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়ল। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের দারিদ্র্য যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। বাবার কৃষিজমি খুব সামান্য, আর সেটাতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়ই ফসল নষ্ট করে দিত। ফসল খারাপ হলে পরিবারকে ধারকর্জ করে বাঁচতে হতো।
অনেক সময় স্কুলে যাওয়ার টিফিনের টাকাও থাকত না। অন্যরা যখন ক্যান্টিন থেকে সমুচা, সিঙ্গারা কিনে খেত, তখন রাহাত দূর থেকে তাকিয়ে থাকত। পেটের ক্ষুধা আর চোখের ক্ষুধা আলাদা হলেও, তার ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে নিজেকে বলত—
“আজ আমার কাছে টাকা নেই, খাবার নেই। কিন্তু একদিন আমি এমন অবস্থায় পৌঁছাব, যখন আমি শুধু নিজের জন্য নয়, অনেকের মুখে হাসি ফোটাতে পারব।
ক্লাসে রাহাত ছিল সবসময় প্রথম সারির ছাত্র। শিক্ষকরা তার অধ্যবসায় দেখে মুগ্ধ হতেন। কিন্তু তার মনের ভেতরে চলত যুদ্ধ—
কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে?
কীভাবে কলেজে ভর্তি হবে, যখন সংসারে চাল কেনার টাকাও নেই?
একবার এক শিক্ষক খেয়াল করলেন, রাহাত কয়েক দিন ধরে ক্লাসে খুব চুপচাপ। জিজ্ঞেস করতেই চোখে পানি এসে গেল তার। বলল, স্যার, আমার কাছে খাতার টাকা নেই। তাই লিখতে পারছি না। শিক্ষক বিস্মিত হয়ে নিজের টাকায় খাতা কিনে দিলেন। সেই দিন রাহাত প্রতিজ্ঞা করল—
একদিন আমি নিজে শিক্ষক হবো। যেমন স্যার আমাকে সাহায্য করেছেন, তেমনিভাবে আমি অন্য গরিব ছাত্রদের সাহায্য করব।
এদিকে গ্রামে অনেকেই তাকে কটাক্ষ করত। কেউ বলতএই ছেলেটা শুধু পড়াশোনা করে, সংসারে কোনো সাহায্য করে না। আবার কেউ বলত—“গরিবের ছেলে কি আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে? শেষমেশ কৃষকই হবে। এসব কথা শুনে তার বুকের ভেতর আগুন জ্বলত। কিন্তু বাইরে সে নিরব থাকত। মনে মনে শুধু বলত
আমি প্রমাণ করব, স্বপ্ন দেখার অধিকার গরিবেরও আছে।
দারিদ্র্যের দেয়াল তার জীবনকে ঘিরে ফেললেও, সেই দেয়াল ভেদ করার শক্তি সে নিজের ভেতর তৈরি করে নিচ্ছিল।
পর্ব ৩ : শহরের আলোর নিচে অন্ধকার
মাধ্যমিক পাস করার পর রাহাতের স্বপ্ন হলো শহরের কলেজে ভর্তি হওয়া। গ্রামের জীবন যতই শান্তিপূর্ণ হোক, সে জানত বড় স্বপ্ন পূরণের জন্য বড় জায়গায় যেতে হবে। কিন্তু শহরে আসা সহজ ছিল না। টাকা নেই, থাকার জায়গা নেই, খাবারের নিশ্চয়তাও সীমিত।
শহরে প্রথম দিনই তার চোখে পড়ল ভিড় আর বিশাল ভবনের আলো। গ্রাম থেকে আসা ছেলেটির জন্য শহর যেন এক অচেনা, কৌশলী প্রাণ। সে প্রথম রাতে মেসে উঠল। মেসের ঘর ছোট, অপরিচ্ছন্ন, আর অন্য শিক্ষার্থীরা তার মতো গরিবকে বেশি প্রাধান্য দেয়নি।
রাহাতকে খরচ জোগাড় করতে হল। দিনে ক্লাস, রাতে টিউশনি—এইভাবে দিন কাটতে লাগল। অনেক রাত সে খালি পেটে ঘুমোতে হয়। একদিন তার বন্ধু শিহাব মজা করে বলল—
দোস্ত, তুমি কি বই খেয়ে বাঁচছ?
রাহাত হেসে বলল—
হ্যাঁ, বইয়ের শক্তিই আমার জীবন বদলাবে।
কলেজের পড়াশোনা কঠিন ছিল। শহরের ছাত্ররা সুপরিচিত স্কুল থেকে এসেছে, নতুন নতুন বই নিয়ে এসেছে। আর রাহাত একেবারেই স্বল্পসাধনের ছাত্র। তবুও সে হাল ছাড়ল না। প্রতিটি ক্লাস, প্রতিটি পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়াশোনা করত।
অনার্সের সময় সে আরও বেশি দায়বদ্ধ হয়ে পড়ল। এখানে ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতা কঠোর। পরীক্ষা ফেইল করলে সময় নেই, একবার সুযোগ চলে গেলে ফিরে পাওয়া কঠিন। রাহাতের মনের ভেতরে একটাই দৃঢ় সংকল্প—
আমি হবেই সফল, যতই বাধা আসুক।
শহরের আলো তার চোখকে মুগ্ধ করলেও সেই আলো
ছিল ভ্রান্তি পূর্ণ। অনেকেই সন্ধ্যার পর শহরের রঙিন জীবন উপভোগ করছিল। কিন্তু রাহাত জানত, তার সময় আর সুযোগ এইসব নেশার জন্য নেই। রাতে সে তার ছোট ঘরে একলা বসে পড়ত, কাগজে খাতায় নোট তুলত, কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলত—
একদিন এই শহরের উঁচু ভবনগুলোতে আমার নামও লেখা থাকবে। এই আলো, এই অন্ধকার, সবই আমার পথ চলার অংশ।
শহরের কঠিন বাস্তবতার মধ্যে রাহাত শিখল—স্বপ্নের জন্য কখনও স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে থেমে থাকা যাবে না। প্রতিটি কষ্টই তাকে শক্তিশালী করছে, প্রতিটি রাতই তাকে তার লক্ষ্যকে আরও কাছে নিয়ে আসছে।
পর্ব ৪ : ব্যর্থতা ও সাহসের খোঁজ
অনার্স শেষ করার পর রাহাতের চোখ ছিল বিসিএস পরীক্ষার দিকে। প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করে দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন তার প্রাণে ভাসছিল। কিন্তু বাস্তবতা সহজ ছিল না। প্রথমবার পরীক্ষা দিলে সে ব্যর্থ হলো। সেই ব্যর্থতা তার ভেতর গভীর হতাশা তৈরি করল।
রাতের ঘরে একা বসে রাহাত নিজের ভুলগুলো ভাবছিল। মনে হচ্ছিল, এত সংগ্রাম, এত রাত জেগে পড়াশোনা—সব বৃথা। কিন্তু তখনই তার মায়ের কথা মনে পড়ল। ফোনে মা বললেন—
বাবা, মনে রাখিস, ব্যর্থতা জীবনের অংশ। চেষ্টা বন্ধ করলে জীবন থেমে যায় না। আল্লাহ্ তোর পরিশ্রমের ফল দিবেন। মায়ের কথায় নতুন শক্তি পেল রাহাত। সে বুঝল, ব্যর্থতা কেবল এক ধাপ, শেষ নয়। সে আরও দৃঢ় হয়ে বসল। তার পরিকল্পনা ছিল কেবল পড়াশোনা নয়, প্রতিটি দুর্বলতাকে শক্তিতে পরিণত করা।
দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিলেও ফলাফল আসল, আবার ব্যর্থতা। অনেকেই বলল,
গরিবের ছেলে, তুমি হয়তো পারবে না।
কিন্তু রাহাত নির্ভীকভাবে বলল,
“আমি শুধু নিজের জন্য পড়ছি না। আমার পরিবার, গ্রাম আর স্বপ্নের জন্য লড়ছি।
এই সময়ে সে আরও একটা শিক্ষা পেল—সংগ্রামের মধ্যে ধৈর্য রাখতে হয়। কখনও কখনও মানুষকে সময় দিতে হয়, সবকিছু একবারে হয় না। রাহাত প্রতিদিন সকালে উঠে নিজেকে বলত—
আজকের চেষ্টা আমার আগের ভুলগুলো ঠিক করবে। হাল ছাড়া আমার জন্য নেই।
তিনি তার বন্ধুদের সাথে পড়াশোনার পরিকল্পনা তৈরি করত। একে অপরকে পরীক্ষা দিত, নোট আদান-প্রদান করত। প্রতিটি ছোট জয় তার মনোবল আরও বৃদ্ধি করত।
শহরের কঠিন জীবন তাকে আরও প্রগাঢ়ভাবে শিখিয়েছে—কেবল মেধা নয়, দৃঢ় সংকল্প, ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সময়ের মূল্য বোঝা প্রয়োজন। এই শিক্ষা তার পরবর্তী সাফল্যের ভিত্তি হয়ে উঠল।
রাহাত জানত, ব্যর্থতা শুধু পথচলার অংশ। প্রতিটি ব্যর্থতা তাকে আরও শক্তিশালী করছে, আরও দক্ষ করছে। আর এই শিক্ষা তাকে একদিন স্বপ্নপূরণের নীল আকাশের দিকে নিয়ে যাবে।
Comments
Post a Comment