অনুপ্রেরণামূলক গল্প: ধানক্ষেতের ছেলে থেকে প্রশাসনের চূড়ায় এক বিসিএস ক্যাডারের সংগ্রামী যাত্রা
ধাপ ১: ধানক্ষেতে জন্ম, স্বপ্নের বীজ
রফিকের জন্ম হয়েছিল এক ছোট্ট গ্রামে, যেখানে শহরের আলো পৌঁছায়নি। তার বাবা হাশেম আলী একজন কৃষক। দিনের শুরু হতো মাঠে কাজ দিয়ে আর শেষ হতো ক্লান্ত শরীরে। রফিক ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে ধানক্ষেতে যেত, গরু চরাতো, মাঝে মাঝে লাঙলও ধরতে হতো। এই কষ্টের ভেতরেও রফিকের মন অন্য কিছু চাইত—জ্ঞান, বইয়ের পাতা আর স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি।
গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল রফিকের জ্ঞানের প্রথম দরজা। যদিও স্কুলে যাওয়া মানেই একজোড়া জুতা মাটি ও কাদায় ভিজে যাওয়া, তবুও সে কখনও অনুপস্থিত থাকত না। স্কুল শেষে সে বাবার সাথে মাঠে কাজ করত এবং রাত জেগে পড়াশোনা চালিয়ে যেত কুপি বাতির আলোয়। গরিব কৃষকের ছেলে হয়েও তার চোখে ছিল এক অদম্য আগুন। সে জানত, এই দারিদ্র্য থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো শিক্ষা।
পঞ্চম শ্রেণিতে রফিক উপজেলা পর্যায়ে মেধাবৃত্তি পায়। এই অর্জন তাকে এবং তার পরিবারকে নতুন আশার আলো দেয়। পাড়ার সবাই বলত, এই ছেলেটা বড় কিছু করবে। কিন্তু বাধা ছিল অনেক। হাইস্কুল ছিল তিন কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হতো। অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টিতেও সে স্কুলে যেত, কাদায় পা ডুবিয়ে।
ক্লাসে সে সবসময় প্রথম হতো। শিক্ষকরা তাকে আলাদাভাবে ভালোবাসতেন। তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়া—একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, যে জনগণের সেবা করবে। সেই সময় তার কাছে এই স্বপ্ন অনেক দূরের মনে হলেও রফিক বিশ্বাস করত—একদিন সে পারবেই।
ধাপ ২: উচ্চশিক্ষার সংগ্রাম ও শহরে বেঁচে থাকা
এসএসসি-তে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে রফিক আবারও আলোচনায় আসে। কিন্তু এবার চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন। তাকে শহরে যেতে হবে কলেজে পড়ার জন্য। বাবা-মার পক্ষে থাকা-খাওয়ার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয় সে। শহরে এসে প্রথম যে বিষয়টা তাকে সবচেয়ে কষ্ট দেয়, সেটা হলো নিজের পরিচয়ের সংকোচ আমি কৃষকের ছেলে, এটা বলার সময় অনেকের চোখে অবহেলা দেখতে পেত সে।
কলেজে ভর্তি হয়ে রফিক পড়াশোনায় মন দেয়। কিন্তু সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক। এক সময় সে টিউশনি শুরু করে। সকালে কলেজ, বিকেলে টিউশনি, রাতে পড়া—এই চক্রেই চলতে লাগল জীবন। মাঝে মাঝে অভুক্ত
থাকতে হতো, টাকার অভাবে বই কিনতে পারত না। কিন্তু সে দমে যেত না। সে জানত, এই কষ্ট একদিন স্বপ্নে রূপ নেবে।
এই সময়ে সে বিসিএস সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে শুরু করে। YouTube, পত্রিকার কাটিং, সিনিয়রদের গাইডলাইন—সব কিছু জোগাড় করে এক বিশাল নোট খাতা তৈরি করে। নিজের স্বপ্নকে আরও বাস্তব মনে হতে থাকে। HSC-তে সে আবারও ভালো ফলাফল করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। এই সময় থেকেই শুরু হয় তার মূল প্রস্তুতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, কোচিং সেন্টার, পুরনো প্রশ্নের অনুশীলন—সব কিছুতেই সে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখে। সারা দিন পড়াশোনার মাঝে থেকেও রাতে সে বাবার কথা মনে করে, মা’র হাতের ভাত মিস করে, গ্রামের সবুজ মাঠ, সেই পাখির ডাক—সব যেন স্বপ্নকে বাস্তব করার অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়।
ধাপ ৩: বিসিএস যুদ্ধের প্রস্তুতি ও আত্মত্যাগ
রফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বিসিএসকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে নেয়। তৃতীয় বর্ষ থেকেই সে পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়—নিয়মিত রুটিন করে পড়ে, বিগত বছরের প্রশ্ন অনুশীলন করে এবং প্রতিটি বিষয়ের দখল রাখে। সে জানত, বিসিএস পরীক্ষায় সাফল্য পেতে হলে শুধু মেধা নয়, প্রয়োজন আত্মনিয়ম, ধৈর্য ও মনোবল।
তবুও, একসময় সে ভেঙে পড়েছিল। প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় লিখিত অংশে ফেল করে। আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই তখন বলেছিল, সবাই কি বিসিএস ক্যাডার হয়?” কিন্তু রফিক থামেনি। সে নিজেকে বলেছিল, “আমি যদি মাঠের ফসল ফলাতে পারি, তবে নিজের ভাগ্যের ফসল কেন নয়?
ধাপ ৪: কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ও বিসিএস ক্যাডারে উত্তীর্ণ
দ্বিতীয় বিসিএস পরীক্ষায় রফিক নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিল। দিনের ১০-১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করত, প্রতিটি বিষয় বিশ্লেষণ করে বুঝত, বিগত প্রশ্নপত্র গুলো বারবার অনুশীলন করত। আত্মবিশ্বাস এবং আত্মত্যাগই ছিল তার মূল অস্ত্র। সে জানত, এই সুযোগ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
ফাইনাল লিখিত পরীক্ষার পরে মৌখিক পরীক্ষায় ডাক আসে। জীবনের প্রথমবার সে টাই পরে ঢাকায় এক সরকারি ভবনে ঢুকেছিল, যেখানে তাকে স্বপ্নের চাকরি নিশ্চিত করার জন্য তার আত্মবিশ্বাস, প্রজ্ঞা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হয়। সে আত্মবিশ্বাসের সাথে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়, নিজের সংগ্রামের গল্প বলে এবং জানায় কেন সে প্রশাসন ক্যাডার হতে চায় অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন এল। বিসিএস রেজাল্ট প্রকাশ হলো। সবার মোবাইলে এসএমএস, ওয়েবসাইটে ভিড়। রফিকেরও কাঁপতে কাঁপতে হাত চলছিল। যখন ফলাফল খুলে নিজের রোল নম্বর দেখে, প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না—সে নির্বাচিত হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারে। চিৎকার করে উঠল, কান্নায় ভেঙে পড়ল। গ্রামের সেই খড়ের ঘরে জন্ম নেওয়া, পায়ে জুতা না থাকা ছেলেটি আজ দেশের একজন গর্বিত সরকারি কর্মকর্তা!
তার বাবা-মা তখন গ্রামের বাড়িতে, বাবার চোখে পানি, মা সেজদায়। সারা গ্রাম আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল, কারণ রফিক শুধু নিজের নয়, গ্রামেরও গর্ব হয়ে উঠেছে। এই সফলতা কেবল তার নয়, তা এক সংগ্রামী পরিবারের বিজয়।
ধাপ ৫: দায়িত্ব, ন্যায় ও উদাহরণ
রফিক এখন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। দায়িত্ব পেয়েছে একটি উপজেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি রোধ, গরিব মানুষদের সেবা ও প্রশাসনের কাজে স্বচ্ছতা আনার মাধ্যমে। সে ভুলে যায়নি নিজের অতীত—ধানক্ষেতের ঘ্রাণ, বাবার ঘাম, মায়ের কান্না। তাই প্রতিটি সিদ্ধান্তে মানুষের কথা ভাবে, বিশেষ করে সেই কৃষক, রিকশাচালক, দিনমজুর—যাদের সন্তানরাও একদিন বড় হতে চায়।
একদিন রফিক অফিসে বসে ছিল, এক কৃষক এসেছিল জমির কাগজ নিয়ে, তার সমস্যা দীর্ঘদিনের। অফিসের অন্যরা ফাইল গোঁজামিল করে রাখছিল, কিন্তু রফিক নিজ হাতে কাগজ নিল, খুঁটিয়ে দেখল, নিজে গিয়ে জায়গা পরিদর্শন করল। সপ্তাহের মধ্যে সমাধান হলো। কৃষকের চোখে পানি, সে বলল স্যার, আপনি না থাকলে আমি জীবনেও এইটা পেতাম না।
রফিক বোঝে, তার এই পদ শুধু ক্ষমতার নয়, বরং তা দায়িত্বের। সে নিয়মিত স্কুলে যায়, ছোটদের উদ্বুদ্ধ করে। নিজের গল্প বলে—কীভাবে গরিব ঘরের ছেলে হয়েও সৎভাবে সাফল্য ধরা যায়। সে চায়, অন্য ছেলেমেয়েরাও যেন নিজের স্বপ্নকে ছোট না ভাবে।
এইভাবেই রফিক এখন শুধু একজন বিসিএস ক্যাডার নয়, বরং একজন আদর্শ, একজন প্রেরণা, একজন আলোর দিশারী হয়ে উঠেছে পুরো সমাজের জন্য।
এরকম বিষয়ে আরোও জানতে এই ওয়েবসাইটের সঙ্গেই থাকুন। এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন নিয়মিত নতুন নতুন বিষয় আপডেট হয়। এছাড়া এই ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিষয়ে পোস্ট রয়েছে যেমন: বিভিন্ন বস্তুর আবিষ্কার ঐতিহাসিক স্থানসমূহ, ছোটদের মজার রূপকথার গল্প, সাফল্য নিয়ে বিখ্যাত মনীষীদের উক্তি এবং স্ট্যাটাস, বিখ্যাত মনীষীদের সাফল্য জীবনকাহিনী, মজার মজার জোকস ও কৌতুক, ভূতের গল্প, শিক্ষনীয় গল্প, প্রেমের কাহিনী, কাব্য উপন্যাস,শরীর সুস্থ রাখার গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তারদের টিপস, ইসলামিক হাদিস , ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি। এই ওয়েবসাইটের https://www.mahadistoryworld.com/