Science Discoveries: The Revolutionary History of the Invention of the Telephone
টেলিফোনের এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের ইতিহাস
ধাপ ১: প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থার বিবর্তন ও টেলিফোনের চাহিদা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করেছে— কখনও ধোঁয়া, কখনও চিত্রাঙ্কন, কখনও শব্দ বা হাতের ইশারার মাধ্যমে। সময় গড়াতে গড়াতে মৌখিক ভাষা এবং লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার মানুষকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। প্রাচীন মিশরীয়রা হায়ারোগ্লিফিক্স ব্যবহার করত, চীনারা ব্যবহার করত কাগজ ও কালি, আর ভারতীয় উপমহাদেশে চিঠির মাধ্যমে দূরবর্তী বার্তা পৌঁছানো হতো।
তবে এই পদ্ধতিগুলো ধীরগতি ও অনির্ভরযোগ্য ছিল। বার্তা পৌঁছাতে কখনও কখনও সপ্তাহ বা মাস লেগে যেত। তারপর আসে কবুতর ডাক, বাদ্যযন্ত্র ও ধ্বনিবাহী দূত। এসব মাধ্যম এককথায় ধীর ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ১৮৩০ সালে স্যামুয়েল মোরস বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ উদ্ভাবন করেন। এটি শব্দের পরিবর্তে সংকেত ব্যবহারে সক্ষম হলেও সরাসরি কথোপকথন সম্ভব ছিল না।
ধীরে ধীরে মানুষের মনে এক প্রশ্ন জাগে— কেন শব্দ বা কণ্ঠস্বরকে বিদ্যুতে রূপান্তর করে দূর থেকে প্রেরণ করা যাবে না?" এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় নতুন এক যন্ত্র আবিষ্কারের প্রচেষ্টা। এমন একটি মাধ্যম দরকার ছিল যা সরাসরি কথা বলার সুবিধা দেবে এবং দ্রুততর হবে। এই প্রয়োজনই জন্ম দেয় আধুনিক টেলিফোন আবিষ্কারের ধারনাকে।
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। শব্দ, তরঙ্গ, বৈদ্যুতিক সংকেত— এসব নিয়ে নানাজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলেই এক সময় টেলিফোনের জন্ম হয়। আর এই বিপ্লবের মূলনায়ক হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল।
📗 ধাপ ২: আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ও টেলিফোনের উদ্ভাবন
টেলিফোন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ নাম হলো আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। তিনি ১৮৪৭ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন এবং ছোটবেলা থেকেই শব্দ, ধ্বনি এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের সহায়তা নিয়ে কাজ করতেন। তাঁর মা ছিলেন বধির এবং বাবা ছিলেন ধ্বনিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, যার প্রভাব বেলের উপর স্পষ্টভাবে পড়ে।
১৮৭০-এর দশকে বেল শব্দ ও বৈদ্যুতিক সংকেত নিয়ে গভীর গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তিনি মনে করতেন, যেভাবে টেলিগ্রাফ বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠাতে পারে, তেমনি শব্দকেও রূপান্তর করে পাঠানো সম্ভব। তিনি তার সহকারী টমাস ওয়াটসনের সাহায্যে একটি যন্ত্র তৈরি করতে থাকেন যা কণ্ঠস্বরকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে দূরে পাঠাবে এবং পুনরায় শব্দে রূপান্তরিত করবে।
১৮৭৬ সালের ১০ই মার্চ, ইতিহাসের প্রথম টেলিফোন কলটি সংঘটিত হয়। বেল বলেছিলেন, Mr. Watson, come here, I want to see you. এই কথাটি শুনে ওয়াটসন পাশের ঘর থেকে এসে উপস্থিত হন। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত— মানুষ প্রথমবারের মতো দূর থেকে সরাসরি কথা বলল!
বেল তাঁর আবিষ্কারের জন্য একই বছর পেটেন্ট লাভ করেন, এবং খুব দ্রুত এই যন্ত্রের চাহিদা বাড়তে থাকে। যদিও এলিশা গ্রে নামক আরেক বিজ্ঞানী একই সময় একইরকম একটি যন্ত্র আবিষ্কারের দাবি করেছিলেন, তবে পেটেন্ট আইনি লড়াইয়ে জয় পান বেল।
এই আবিষ্কারের পরেই বেল টেলিফোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাণিজ্যিকভাবে টেলিফোন ব্যবহারের পথ খুলে যায়। এই কোম্পানিই পরবর্তীকালে ‘AT&T’ নাম নেয় এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টেলিকম প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়।
📙 ধাপ ৩: প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও টেলিফোনের বিস্তার
আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের আবিষ্কারের পর টেলিফোন প্রযুক্তি থেমে থাকেনি। বরং এর উন্নয়ন ও বিস্তার হয় দ্রুতগতিতে। ১৮৭৭ সালে বেল টেলিফোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই টেলিফোনকে ঘিরে শুরু হয় বাণিজ্যিক বিপ্লব। প্রথম দিকে সীমিত এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও কয়েক বছরের মধ্যেই শহর থেকে শহরে সংযোগ স্থাপন শুরু হয়।
প্রথম দিকে টেলিফোন ব্যবস্থায় অপারেটর ম্যানুয়ালি দুটি কলারকে সংযুক্ত করতেন। কিন্তু এই পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ ও অস্বস্তিকর ছিল। তাই শুরু হয় স্বয়ংক্রিয় এক্সচেঞ্জ প্রযুক্তির উদ্ভাবন। ১৮৯১ সালে অলমার স্ট্রোজার নামে এক উদ্ভাবক প্রথম স্বয়ংক্রিয়
টেলিফোন এক্সচেঞ্জ চালু করেন।
বিশ্বজুড়ে টেলিফোন লাইন বসাতে শুরু হয়। ১৯২৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রথম ট্রান্সআটলান্টিক টেলিফোন কল সম্পন্ন হয়, যা ছিল এক ঐতিহাসিক অর্জন। এরপর ১৯৩০-এর দশকে টেলিফোন অফিস ও হোমে আরও বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে।
১৯৪০-৫০-এর দশকে আসে রোটারি ডায়াল ফোন, যেখানে ব্যবহারকারী নিজেই নম্বর ঘুরিয়ে কল করতে পারতেন। এরপর আসে টাচটোন ফোন যা নম্বর ডায়ালকে আরও সহজ করে তোলে।
এই সময়েই সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা, হাসপাতাল ও ব্যাংকে টেলিফোন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। মানুষ ঘরে বসেই তথ্য নিতে পারত, যোগাযোগ করতে পারত। এটি সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে পরিবর্তন এনে দেয়।
তবে তখনও টেলিফোন ছিল তারযুক্ত এবং নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপনযোগ্য। তাই প্রযুক্তির পরবর্তী লক্ষ্য ছিল, কিভাবে মানুষকে মোবাইল বা তারহীন সুবিধা দেওয়া যায়। আর সেই ভাবনা থেকেই মোবাইল টেলিফোন প্রযুক্তির পথ তৈরি হতে থাকে।
📕 ধাপ ৪: মোবাইল, স্মার্টফোন ও টেলিফোনের আধুনিক রূপ
১৯৭৩ সালে মার্টিন কুপার, যিনি মটোরোলায় কর্মরত ছিলেন, প্রথম সফলভাবে একটি মোবাইল ফোন কল করেন। এ ছিল বিশ্ব ইতিহাসে মোবাইল ফোন প্রযুক্তির সূচনা। প্রথম দিকের মোবাইল ফোন বড় ও ভারী ছিল এবং চার্জ কম থাকত। তবে ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মোবাইল ছোট ও হালকা হতে থাকে।
স্মার্টফোন ধারণা আসে ২০০০-এর দশকে। এতে টেলিফোন ছাড়াও ইন্টারনেট, ক্যামেরা, ভিডিও কল, অ্যাপস ইত্যাদি যুক্ত হয়। এখন মানুষ শুধু কথা বলেই না, ই-মেইল, ভিডিও কনফারেন্স, অনলাইন লেনদেনসহ অসংখ্য কাজ করে একটি ফোনের মাধ্যমে।
VoIP (Voice over IP) প্রযুক্তি এসেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কল করার সুবিধা নিয়ে। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, জুম, গুগল মিট— এসবের মাধ্যমে এখন পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বিনামূল্যে কথা বলা সম্ভব। এই প্রযুক্তি মানুষকে সত্যিকার অর্থেই এক ক্লিকে সংযুক্ত করে দিয়েছে।
টেলিফোন এখন আর বিলাসবস্তু নয়, বরং মানবজীবনের মৌলিক প্রয়োজনের একটি অংশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসন, কৃষি, ব্যবসা— সবখানেই টেলিফোন এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান।
তবে টেলিফোনের নেতিবাচক দিকও আছে। অতিরিক্ত ব্যবহার, গোপনীয়তা লঙ্ঘন, আসক্তি— এসব সমস্যা সৃষ্টি করছে। তবুও টেলিফোনের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। এটি মানব সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার, যা আজও মানবজীবনকে নতুন নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে।