রূপকথার গল্প

 

গল্প: নীল অরণ্যের রহস্য

ধাপ–১ : হারানো গ্রামের কাহিনী

বাংলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল সোনাঝরা গ্রাম। চারদিকে ধানের ক্ষেত, মাঝখানে ছোট্ট নদী, আর গ্রামের পাশে শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত নীলাভ বনের বিস্তার। গ্রামের মানুষজন একে বলত নীল অরণ্য। গাছের পাতাগুলো অদ্ভুতভাবে নীলাভ আলো ছড়াত, বিশেষ করে রাতে। অনেকেই বলত, সেই বনের ভেতরে লুকিয়ে আছে জাদুর রহস্য।
কিন্তু ভয়ে কেউ সেখানে যেত না। শোনা যেত, বহু বছর আগে রাজ্যের এক নিষ্ঠুর রাজা তার ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিল ওই বনের গভীরে। ধনরত্ন পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে গিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ, যা আজও সক্রিয়।

গ্রামের সবাই এসব গল্প এড়িয়ে যেত, কিন্তু গ্রামের এক কিশোর অরিন্দম বিশ্বাস করত—ওই বনের রহস্য শুধু ভয় নয়, কোনো সত্যও লুকিয়ে আছে।


ধাপ–২ : অরিন্দমের সিদ্ধান্ত

অরিন্দম ছিল দুঃসাহসী আর কৌতূহলী। ছোট থেকেই সে গ্রামের বৃদ্ধদের কাছ থেকে নীল অরণ্যের রহস্য” শুনে বড় হয়েছিল। একদিন হাট থেকে ফেরার পথে সে দেখতে পেল, এক বৃদ্ধা বন থেকে বেরিয়ে এলেন, হাতে একটি ছোট্ট নীল আলো ঝলমল করা পাথর।
অরিন্দম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— দাদি, এটা কোথা থেকে পেলেন?
বৃদ্ধা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন,
— “বনের ভেতর সত্য লুকিয়ে আছে, ছেলে। তবে যারা ভয় জয় করতে পারে, কেবল তারাই সেই সত্য খুঁজে পায়।”
সেদিন রাতে অরিন্দম ঠিক করল—সে একাই বনে যাবে। হয়তো কোনো গোপন ধন, হয়তো কোনো জাদুর রহস্য—যাই হোক, তাকে জানতে হবে।

ধাপ–৩ : নীল অরণ্যে প্রবেশ

ভোরের আলো ফোটার আগেই অরিন্দম একটি লাঠি, কিছু শুকনো খাবার আর পানির কলস নিয়ে নীল অরণ্যের দিকে রওনা দিল।
প্রথমে বনটা স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। পাখির ডাক, গাছের ছায়া, হাওয়ার শীতল পরশ—সবকিছুই শান্ত। কিন্তু যত গভীরে যাচ্ছিল, ততই বাতাস ভারি হতে লাগল, আর পাতাগুলো নীল আলোয় ঝলমল করতে লাগল।
একসময় সে দেখল, সামনে পথ দুটি ভাগ হয়ে গেছে। বাঁ দিকে আঁকাবাঁকা পথ, ডান দিকে সোজা কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন্ন।
মনে পড়ল গ্রামের বৃদ্ধা বলেছিলেন—সোজা পথ সবসময় সঠিক হয় না। তাই অরিন্দম বেছে নিল বাঁ দিকের আঁকাবাঁকা পথ।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কানে এল কারো কান্নার শব্দ। কাছে গিয়ে দেখে, এক ছোট্ট হরিণী শিকারির ফাঁদে আটকা। অরিন্দম দ্রুত ফাঁদ কেটে তাকে মুক্ত করল। অবাক হয়ে দেখল, মুক্ত হতেই হরিণী মানুষের ভাষায় বলল,

তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। আমি এই বনের রক্ষক দেবতার দূত। তোমার সামনে অনেক বিপদ আসবে, কিন্তু মনে রেখো, সাহসী হৃদয়ের পাশে সবসময় সাহায্য থাকে।
বলেই হরিণী মিলিয়ে গেল।

ধাপ–৪ : রহস্যের দ্বার

বনের আরো গভীরে গিয়ে অরিন্দম দেখতে পেল একটি বিশাল গুহা, যার দরজায় অদ্ভুত সব চিহ্ন খোদাই করা। দরজার ওপরে লেখা—
সাহস, দয়া আর সত্য—এই তিনে খুলবে দ্বার।
অরিন্দম কিছুক্ষণ ভেবে দেখল—এটার মানে কী হতে পারে?
তখনই মনে পড়ল, সে তো দয়ার পরিচয় দিয়েছে হরিণীকে বাঁচিয়ে। এখন দরকার সাহস আর সত্যের পরীক্ষা।
হঠাৎ দরজা থেকে ভয়ংকর এক ছায়া বেরিয়ে এসে বলল,
— তুমি যদি ভেতরে ঢুকতে চাও, তবে আমাকে জিততে হবে।
অরিন্দম ভয় পেলেও সাহস সঞ্চয় করল। ছায়াটা তার মনের ভয়কে বাস্তবে রূপ দিচ্ছিল—কখনো সাপ, কখনো বাঘ, কখনো অন্ধকার গহ্বর।

অরিন্দম মনে মনে বলল, এগুলো আসল নয়, এ শুধু আমার ভয়ের ছায়া। সে চোখ বন্ধ করে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেল। ছায়া মিলিয়ে গেল।
দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল, ভেতরে জ্বলে উঠল নীল আলো।

ধাপ–৫ : নীল অরণ্যের গোপন রহস্য

ভেতরে ঢুকেই অরিন্দম অবাক হয়ে দেখল—সোনার ধনরত্ন নয়, বরং সেখানে রাখা আছে এক বিশাল পাথরের ফলক। তাতে লেখা:
মানুষের লোভই তার শত্রু। সত্যিকার ধনরত্ন ধন-সম্পদ নয়, দয়া আর সাহস।
অরিন্দম বুঝল, রাজা তার ধনরত্ন লুকায়নি, বরং রেখে গিয়েছিল শিক্ষা। যে শিক্ষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—টাকা-পয়সা নয়, গুণই আসল সম্পদ।
তখনই সেই হরিণী আবার হাজির হলো।
অরিন্দম, তুমি প্রমাণ করেছ দয়া, সাহস আর সত্যের যোগ্যতা। এখন থেকে এই বনের আলো তোমার গ্রামকে রক্ষা করবে।
হরিণী একটি নীল রত্ন দিল তাকে।
অরিন্দম ফিরে গিয়ে গ্রামবাসীদের সবকিছু জানাল। সেই থেকে সোনাঝরা গ্রামে আর কোনো দুঃখ-দুর্দশা আসেনি। নীল অরণ্য হয়ে উঠল আশীর্বাদের প্রতীক।


গল্প: নীল অরণ্যের অভিশাপ 

ধাপ–১ : অশান্তির আগমন

অরিন্দম যখন নীল রত্ন নিয়ে গ্রামে ফিরে এল, সবার আনন্দের সীমা রইল না। গ্রামে আবার শান্তি ফিরে এল। ধান ভালো হলো, রোগব্যাধি কমে গেল, নদীতে মাছ ভরে উঠল। সবাই ভাবল—অরিন্দম সত্যিই ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
কিন্তু সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। একদিন দূরের এক বণিকদল খবর পেল এই নীল রত্নের কথা। তাদের নেতা কৃষ্ণনাথ ছিল লোভী আর ধূর্ত মানুষ। সে বিশ্বাস করত—রত্নটি শুধু আলো ছড়ায় না, এর ভেতরে আছে অজস্র ধন-সম্পদের গোপন শক্তি।
সে পরিকল্পনা করল, যেভাবেই হোক গ্রাম থেকে রত্নটা দখল করতে হবে।

ধাপ–২ : ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ

কৃষ্ণনাথ রাতে কয়েকজন লোক নিয়ে চুপিচুপি গ্রামে ঢুকল। তারা ভেবেছিল, সহজেই রত্ন চুরি করে পালাবে। কিন্তু অরিন্দম তখন সতর্ক ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল—রত্ন শুধু পাওয়া নয়, এটা রক্ষা করাও দায়িত্ব।
চোরেরা যখন মন্দির থেকে রত্ন নিতে গেল, তখন হঠাৎ পুরো গ্রাম আলোয় ভরে উঠল। নীলাভ আলো এমনভাবে ঝলসে উঠল যে চোরেরা চোখ মেলতে পারল না। তারা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।
কৃষ্ণনাথ তখনই প্রতিজ্ঞা করল—
আমি হাল ছাড়ব না। এই রত্ন না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেব না।

ধাপ–৩ : অরিন্দমের দ্বিধা

এদিকে অরিন্দম চিন্তায় পড়ল। সে ভাবল—এখন তো শুধু রত্নের রহস্য জানা নয়, বরং গ্রামকে লোভী মানুষের হাত থেকে রক্ষা করাও জরুরি।
সে আবার বনে গিয়ে হরিণীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলো। গভীর রাতে নীল অরণ্যে প্রবেশ করলে আবার হরিণী হাজির হলো।
অরিন্দম বলল,
দূরের মানুষ রত্ন দখল করতে আসছে। আমি কীভাবে গ্রামকে রক্ষা করব?
হরিণী বলল,
রত্নের আসল শক্তি লুকিয়ে আছে তোমার সাহসে। তবে সাবধান—লোভী মানুষের লড়াই কেবল অস্ত্র দিয়ে নয়, মনের শক্তি দিয়েও জিততে হয়। তুমি চাইলে বন দেবতা তোমাকে সাহায্য করবে, তবে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।

ধাপ–৪ : অভিশপ্ত গুহা

হরিণী অরিন্দমকে নিয়ে গেল বনের গভীরে এক নতুন গুহার সামনে। সেখানে লেখা ছিল—
অভিশাপ ভাঙলে তবেই শক্তি জাগবে।
গুহার ভেতর ঢুকতেই অরিন্দম দেখতে পেল ভয়ঙ্কর দৃশ্য—গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, কালো ছায়ারা চারদিকে ঘুরছে। হরিণী বলল, বহু আগে রাজা শুধু শিক্ষা রাখেনি, বরং একটা পরীক্ষা রেখে গিয়েছিল। যদি মানুষ লোভে পড়ে রত্ন দখল করতে আসে, তবে বনে অভিশাপ নেমে আসবে।
অরিন্দমের সামনে তখন তিনটি দরজা খুলল—
১. ভয়ের দরজা
২. প্রলোভনের দরজা
৩. সত্যের দরজা
সে জানত, ভুল দরজা পা দিলেই চিরদিন অভিশপ্ত হয়ে যাবে।

ধাপ–৫ : সত্যের জয়ে বিজয়

অরিন্দম সাহস নিয়ে “সত্যের দরজা বেছে নিল। ভেতরে ঢুকতেই সে দেখল কৃষ্ণনাথ এবং তার দলও কোনোভাবে গুহায় ঢুকে পড়েছে। তারা রত্ন কাড়ার জন্য ছুটে আসছিল।

হঠাৎ গুহার ভেতর থেকে বজ্রধ্বনি শোনা গেল—
— “যারা লোভ করে, তারা ধ্বংস হবে। যারা সত্য আঁকড়ে ধরে, তারাই আশীর্বাদ পাবে।
কৃষ্ণনাথ ভয়ে পেছাতে চাইল না। সে রত্নের দিকে দৌড় দিল। মুহূর্তেই কালো আগুনে সে পুড়ে ছায়ায় মিলিয়ে গেল। বাকিরা আতঙ্কে পালাল।
অরিন্দম তখন মাথা নত করে বলল,
—্আমি শুধু গ্রামকে রক্ষা করতে চাই, রত্নের শক্তি চাই না।
সঙ্গে সঙ্গে গুহার অন্ধকার কেটে গিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ল। অভিশাপ ভেঙে গেল।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url