সাহিত্য গল্প: সময়ের সেতু
সময়ের সেতু
ছোটবেলা থেকে জয়নালের স্বপ্ন ছিল—একটা বইয়ের দোকান। এমন না যে তিনি বইয়ের পোকা ছিলেন, কিন্তু বইয়ের গন্ধ, পাতার শব্দ আর মানুষের মুখে গল্প শোনার ব্যাকুলতা তাঁকে বইয়ের জগতে টেনেছিল। স্কুলের পাশে একটা পুরনো লাইব্রেরি ছিল, নাম—অলিন্দ পাঠাগার। ছাতাটা ছিল টিনের, বর্ষায় ছাতফাটা শব্দে বৃষ্টির নাচ, আর কড়কড়ে রোদে সেই টিন তপ্ত হয়ে উঠত আগুনের মতো।
সে লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান ছিলেন এক বৃদ্ধ, সরদার সাহেব। দাঁড়িগোঁফ সাদা, কিন্তু গলার স্বর এতটাই কোমল, যেন বইগুলো তাঁর সন্তান। জয়নাল স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই চলে যেত সেখানে। কোনোদিন চুপচাপ বসে থাকত, কোনোদিন বই না খুলেই তাকিয়ে থাকত মেঝের ছায়ার খেলায়।
তখন তার বয়স বারো।
জয়নালের বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। সংসারে টানাটানি, তবে ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু ১৯৯৮ সালের সেই শীতের সকালটা সবকিছু পাল্টে দিয়েছিল। বাবাকে হারানোর পর মা-বেটার সংসারটা যেন হঠাৎ করেই ছোট হয়ে এল। কাঁধে দায়িত্বের ভার চাপল, স্বপ্নটা যেন ধুলোমলিন হয়ে গেল। কিশোর বয়সের সেই বইয়ের দোকান খোলার স্বপ্ন হারিয়ে গেল হাড়ভাঙা খাটুনির ভেতর।
সময়ের স্রোত গড়িয়ে গেল। জয়নাল কলেজে ভর্তি হতে পারল না। বাজারে চাকরি, গুদামে মাল তোলা, সব কাজই করেছে। মাঝে মাঝে অলিন্দ পাঠাগারে যেত, কিন্তু একসময় সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। শুনল, সরদার সাহেব মারা গেছেন। পাঠাগার ভেঙে সেখানে এখন এক চাইনিজ রেস্তোরাঁ।
তারপর একদিন...
চল্লিশ পেরনো এক সকালে, নিজের চায়ের দোকানে বসে চা বানাচ্ছিল জয়নাল। রাস্তার পাশে সাদা পাঞ্জাবি-পরা একজন মানুষ এসে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল অপরিচিত কিছু উজ্জ্বলতা।
— আপনার নাম জয়নাল?
জয়নাল চমকে তাকাল।
হ্যাঁ, বলুন।
আমি সরদার সাহেবের নাতি। আপনি কি অলিন্দ পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক ছিলেন?
আশ্চর্য হয়ে গেল জয়নাল। অনেক বছর পর সে নাম কেউ বলল! বুকের ভেতর কেমন যেন একটা ঢেউ উঠল।
হ্যাঁ, আমি প্রায়ই যেতাম। ওখানে আমার অনেক স্মৃতি… আপনি কীভাবে?
নানার একটা পুরনো নোটবুক পেয়েছি। সেখানে আপনাকে নিয়ে অনেক কিছু লেখা আছে। আপনি নাকি একদিন বলেছিলেন, আপনার স্বপ্ন—একটা বইয়ের দোকান?
জয়নাল চুপ করে রইল। কথাটা শুনে বুকের ভেতর যেন কিসের চাপ পড়ে গেল। সত্যিই তো, কথাটা সে বলেছিল একদিন। কিন্তু আজ? আজ সে একজন চা-ওয়ালা, জীবনের চাপে স্বপ্নগুলো একে একে ছিঁড়ে গেছে।
আপনার জন্য একটা জিনিস আছে।
পাঞ্জাবিপরা লোকটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করল। ভেতরে একটা চাবি।
নানা একটা দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন একদিন আপনাকে উপহার দেবেন। কিন্তু সময়ের অভাবে আর বলা হয়নি। আজ আমি সেই দায়িত্বটা পালন করতে চাই।
চোখ ছলছল করে উঠল জয়নালের। এত বছর পর কেউ তার স্বপ্নের কথা মনে রেখেছে!
২. দোকানটা শহরের এক কোণায়, ব্যস্ত রাস্তা থেকে একটু দূরে। দুইতলা বাড়ির নিচতলায় ছোট্ট একটা ঘর। দরজা খোলামাত্র ভেতরে ধুলার গন্ধ, ভাঙা তাক, পুরনো ক্যালেন্ডার। কিন্তু জানালার বাইরে গাছের ছায়া, বাতাস, আর দেয়ালের দিকে তাকালেই বোঝা যায়—এটা একটা সম্ভাবনার ঘর।
জয়নাল দিনরাত খেটে ঘরটা সাজাল। পুরনো বই কিনল, কিছু দান করল সরদার সাহেবের পরিবার। দোকানের নাম রাখল—অলিন্দ আবার।
প্রথম দিকে কেউ আসত না। সবাই বলে, বইয়ের দোকান দিয়ে কী হবে? এখন তো সবাই ফোনেই পড়ে! কিন্তু ধীরে ধীরে লোক জড়ো হতে লাগল। কেউ গল্প শোনাতে আসে, কেউ পুরনো বই খুঁজতে, কেউ কেবল সময় কাটাতে।
তিন মাসের মধ্যে দোকানটা একটা ছোট কমিউনিটি সেন্টারে রূপ নিল। বিকেল বেলায় কিছু স্কুলের ছেলেমেয়ে এসে চুপচাপ বসে থাকে, কেউ কবিতা পড়ে, কেউ গল্প লেখে। জয়নাল তাদের পাশে বসে বলে,
তোমরা যা ইচ্ছা হতে পারো, শুধু স্বপ্নটা ভুলে যেয়ো না।
৩. একদিন এক নারী এল দোকানে। পরনে শাড়ি, হাতে একটা খাতা।
আমি রুবি। লেখালিখি করি। শুনেছি, এখানে নতুন লেখকদের লেখা প্রকাশ করেন?
জয়নাল তাকাল তাঁর দিকে। শান্ত চোখ, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গিতে দৃঢ়তা।
— হ্যাঁ, আমরা প্রতি তিন মাসে একটা ছোট পত্রিকা বের করি। আপনি কিছু জমা দিতে চান?
রুবি একটা গল্প দিল। পড়ে জয়নাল অভিভূত হয়ে গেল। এমন ভাষা, এমন আবেগ! তাঁর মনে হলো—এই লেখিকা অনেক দূর যাবে।
এরপর রুবি প্রায়ই আসত। বই পড়ত, নতুন লেখকদের সঙ্গে সময় কাটাত। একসময় তারা মিলে একটা সাহিত্য ক্লাব গড়ে তুলল—নাম অলিন্দের বন্ধুরা।
এই ক্লাব থেকেই শুরু হলো পথের শব্দ নামের একটা সাহিত্য ম্যাগাজিন। প্রতি সংখ্যায় থাকত গল্প, কবিতা, আলোচনা, আর স্থানীয় লেখকদের চিঠি।
অলিন্দ আবার হয়ে উঠল সময়ের সেতু—যেখানে নতুনরা খুঁজে পায় সাহস, আর পুরনোরা খুঁজে পায় স্মৃতি।
৪. দশ বছর কেটে গেল।
জয়নাল এখনও সেই দোকানের মালিক, কিন্তু সে আর কেবল চা-ওয়ালা নয়। সে এখন স্বপ্নের এক সেতুবন্ধনকারী। অলিন্দ আবার এখন একটি ছোট প্রকাশনী সংস্থা। রুবি এখন একজন বিখ্যাত লেখিকা, তার লেখা পড়ানো হয় বিভিন্ন স্কুলে।
তাদের ভালোবাসাও গড়েছে এক শান্ত সুরে। দু’জনেই বুঝেছে—জীবনে স্বপ্ন না থাকলে বাঁচার মানে থাকে না। আর ভালোবাসা? সে তো সময়ের ভেতর দিয়েই ধীরে ধীরে পূর্ণতা পায়।
শেষাংশ
জয়নাল আজ বসে আছে অলিন্দ আবার-এর বারান্দায়। বৃষ্টির শব্দে ছাতের টিন কাঁপছে, ঠিক সেই পুরনো লাইব্রেরির মতো। এক পাতা খোলা বই সামনে, পাশে একদল তরুণ ছেলেমেয়ে গল্প লেখায় ব্যস্ত।
হঠাৎ করে জয়নালের মনে হয়—সময় হয়তো চলে যায়, মানুষও বদলায়, কিন্তু কোনো কোনো স্বপ্ন থাকে যা সময়ের সেতু হয়ে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে এগিয়ে যায়।
এটাই বোধহয় জীবনের আসল গল্প।
এরকম বিষয়ে আরোও জানতে এই ওয়েবসাইটের সঙ্গেই থাকুন। এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন নিয়মিত নতুন নতুন বিষয় আপডেট হয়। এছাড়া এই ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিষয়ে পোস্ট রয়েছে যেমন: বিভিন্ন বস্তুর আবিষ্কার ঐতিহাসিক স্থানসমূহ, ছোটদের মজার রূপকথার গল্প, সাফল্য নিয়ে বিখ্যাত মনীষীদের উক্তি এবং স্ট্যাটাস, বিখ্যাত মনীষীদের সাফল্য জীবনকাহিনী, মজার মজার জোকস ও কৌতুক, ভূতের গল্প, শিক্ষনীয় গল্প, প্রেমের কাহিনী, কাব্য উপন্যাস,শরীর সুস্থ রাখার গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তারদের টিপস, ইসলামিক হাদিস , ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি। এই ওয়েবসাইটের https://www.mahadistoryworld.com/