রোবট আবিষ্কারের ইতিহাস
রোবট আবিষ্কারের ইতিহাস
প্রাচীন যুগের কল্পনা ও যান্ত্রিক মানব
রোবটের ধারণা নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই মানুষ যন্ত্রচালিত কৃত্রিম মানব বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের কল্পনা করত। প্রাচীন গ্রিক পুরাণে হেফায়স্টাস নামক দেবতা একটি স্বর্ণের রোবট বানিয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে, যা কথা বলতে পারত এবং মানুষের মতো কাজ করতে পারত। একইভাবে, চীনের হান রাজবংশের সময় একজন কারিগর যান্ত্রিক পুতুল বানান, যা হাত নেড়েছিল, গান গেয়েছিল।
আরব বিজ্ঞানী আল-জাযারির (১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) আবিষ্কারও রোবটের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল স্বয়ংক্রিয় জলঘড়ি, হাত ধোয়ার যন্ত্র এবং একটি যান্ত্রিক সংগীত পরিবেশক দল—যা কিছুটা আধুনিক রোবটের পূর্বসূরি।
রেনেসাঁ যুগ ও যান্ত্রিক মানবদেহ
১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে ইউরোপে বিজ্ঞান ও শিল্পের নবজাগরণ ঘটে। এই সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও উদ্ভাবক লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৪৯৫ সালে একটি যান্ত্রিক নাইট ডিজাইন করেন। এটি ছিল ধাতব কাঠামোযুক্ত একটি রোবট, যার হাত-পা নড়াচড়া করত এবং বসতেও পারত।
১৮শ শতকে ইউরোপে তৈরি হয় অনেক যান্ত্রিক পুতুল (automaton), যেগুলো দেখতে ছিল মানুষের মতো এবং কিছু কাজও করতে পারত, যেমন: গান গাওয়া, কলমে লিখা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো ইত্যাদি। যদিও এগুলো পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ছিল না, তবে এগুলো আধুনিক রোবটের ভাবনার বীজ বপন করেছিল।
রোবট শব্দের উৎপত্তি
রোবট শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯২০ সালে চেক লেখক কারেল চাপক-এর নাটক R.U.R (Rossum’s Universal Robots)-এ। নাটকে রোবটরা ছিল কৃত্রিম মানব, যারা মানুষের মতো কাজ করত এবং একসময় মানুষকে বিদ্রোহ করে দমন করত। এখান থেকেই Robot শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। এটি এসেছে চেক শব্দ robota থেকে, যার অর্থ শ্রমিক বা দাসত্বমূলক কাজ।
আধুনিক রোবটের উত্থান
রোবটের আধুনিক রূপ পেতে শুরু করে ২০শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে। ১৯৪০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং পরে প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি হয়। তখন থেকেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।
১৯৫৪ সালে জর্জ ডেভল নামক একজন আমেরিকান প্রকৌশলী প্রথম Unimate নামে একটি প্রোগ্রামযোগ্য রোবট তৈরি করেন। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল নিয়ন্ত্রিত রোবট, যা ১৯৬১ সালে জেনারেল মোটরস কোম্পানিতে একটি ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার হয়। এটাই ছিল শিল্পখাতে রোবট ব্যবহারের সূচনা।
রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)
১৯৫৬ সালে John McCarthy সহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে Artificial Intelligence শব্দটি প্রস্তাব করেন। এরপর থেকেই রোবটকে শুধু যন্ত্র হিসেবে নয়, বরং বুদ্ধিমান যন্ত্র হিসেবেও গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয়।
এরপর ১৯৭০–৮০-এর দশকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রোবটিক্স নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। সেই সময় Sony, Honda, Mitsubishi-এর মতো কোম্পানিগুলো রোবট নির্মাণে বড় অবদান রাখে।
রোবট আজ কোথায়?
বর্তমানে রোবট শুধু ফ্যাক্টরিতে নয়, বরং—
চিকিৎসাক্ষেত্রে: অপারেশন রোবট (যেমন: da Vinci Surgical System)
মহাকাশে: NASA’র Mars Rover বা চাঁদের যান
গৃহস্থালি: স্মার্ট ভ্যাকুয়াম রোবট, কিচেন সহকারী রোবট
সামরিক খাতে: ড্রোন, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী রোবট
পর্যটন ও সেবা খাতে: হোটেলে রোবট ওয়েটার, তথ্য সহায়ক রোবট
এছাড়া, AI-এর সাথে মিলিয়ে আজকের রোবট নিজের থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, কথা বলছে, এমনকি আবেগ অনুকরণও করছে। ChatGPT-এর
Honda's ASIMO রোবট (২০০০ সাল) মানুষের মতো হাঁটতে, কথা বলতে এবং পরিবেশ বুঝতে পারত—এটি ছিল মানব সদৃশ (humanoid) রোবটের একটি বড় অগ্রগতি।মতো ভাষাভিত্তিক মডেলও রোবট প্রযুক্তিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
উপসংহার
রোবটের ইতিহাস শুধু যন্ত্রের নয়, এটি মানুষের কল্পনা, চিন্তা, এবং প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস। প্রাচীন কল্পনার রোবট আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, এবং আগামী দিনগুলোয় আমাদের জীবনের আরও বড় অংশ হয়ে উঠবে। তবে এর ব্যবহার যেন মানবতার কল্যাণে হয়, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
Comments
Post a Comment