ইসলামে পড়ালেখা ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব: হাদিসের আলোকে
ইসলাম ধর্মে শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অত্যন্ত গভীরভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে পড়ালেখা ও জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব নিয়ে অসংখ্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর হাদিসসমূহেও আমরা শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে অসংখ্য মূল্যবান বার্তা পাই। নিচে হাদিস শরীফের বিভিন্ন কিতাব থেকে পড়ালেখা ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব নিয়ে ৯০০ শব্দের আলোচনা তুলে ধরা হলো:
১. প্রথম নির্দেশনা: জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ
হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন:
জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। (ইবনে মাজাহ: ২২৪)
এই হাদিসটি শিক্ষা দেয় যে, ইসলাম ধর্মে পুরুষ এবং নারী উভয়ের জন্যই জ্ঞান অর্জন বাধ্যতামূলক। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই শিক্ষার গুরুত্ব অত্যন্ত উঁচু স্থানে ছিল। কেবল ধর্মীয় জ্ঞানই নয়, ধর্মীয় বিষয়ের বাইরের সাধারণ জ্ঞানও অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয়। এই হাদিস মুসলিম উম্মাহকে নির্দেশ করে যে, জ্ঞানার্জন শুধু ইবাদতের মাধ্যম নয়, বরং দুনিয়া এবং আখিরাতের কল্যাণের জন্য অপরিহার্য।
২. শিক্ষা ও জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ
মহানবী (স.) আরও বলেছেন:
যে ব্যক্তি জ্ঞান অনুসন্ধানের জন্য একটি পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। (মুসলিম: ২৬৯৯)
এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে যে জ্ঞানার্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করা কেবল পৃথিবীর কল্যাণে নয়, পরকালের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথ দেখান এবং তাদের জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।
৩. জ্ঞানের সাথে আমল (কর্ম)
শুধু জ্ঞান অর্জন করাই যথেষ্ট নয়, সেই জ্ঞানকে কাজে লাগানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে এসেছে:
যে ব্যক্তি তার জ্ঞান অনুযায়ী আমল করে, আল্লাহ তাকে এমন জ্ঞান দেন যা সে আগে জানত না। (আবু দাউদ: ৩৫৯৭)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, জ্ঞানার্জন ও আমল দুটোই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তিকে আরও জ্ঞান দেন যে তার অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করে।
৪. জ্ঞানের মর্যাদা
হযরত আবু হুরায়রা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি জিনিসের আমল চলতে থাকে: (১) সদকায়ে জারিয়া, (২) এমন জ্ঞান যা মানুষকে উপকৃত করে, এবং (৩) সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম: ১৬৩১)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, জ্ঞান এমন এক সম্পদ যা মৃত্যুর পরেও মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। কেউ যদি এমন জ্ঞান অর্জন করে যা অন্যদের উপকারে আসে, তবে তা তার মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে।
জ্ঞান অন্বেষণের মহিমা
মহানবী (স.) আরও বলেন:
জ্ঞান অন্বেষণের জন্য যারা বের হয়, ফেরেশতারা তাদের পায়ের নিচে ডানা বিছিয়ে দেয়। (তিরমিজি: ২৬৮২)
এই হাদিসে আল্লাহর প্রিয়তা এবং জ্ঞানার্জনের মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ফেরেশতাদের এমন ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা তাদের জন্য যারা জ্ঞান অনুসন্ধান করেন, এটি প্রমাণ করে যে জ্ঞানার্জনকে আল্লাহর নিকট কতটা মূল্যবান হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
৬. সর্বোত্তম মানুষ জ্ঞানী ব্যক্তি
মহানবী (স.) বলেছেন:
তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়। (বুখারি: ৫০২৭)
এই হাদিসটি কুরআন শিক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা এবং তা অন্যদের শেখানোকে সবচেয়ে উত্তম কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ইসলামি শিক্ষার মৌলিক দিক এবং এটি জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার গুরুত্ব তুলে ধরে।
৭. পৃথিবীর বুকে জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা
হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন:
জ্ঞানী ব্যক্তি এবং ইবাদতকারী ব্যক্তির মধ্যে এমন পার্থক্য রয়েছে, যেমন পূর্ণিমার চাঁদ এবং অন্যান্য তারার মধ্যে পার্থক্য। (তিরমিজি: ২৬৮৫)
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, একজন জ্ঞানীর মর্যাদা কতটা উঁচু। যদিও ইবাদত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবুও সেই ইবাদত তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন তা জ্ঞানের আলোকে পরিচালিত হয়। জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে এবং তার ইবাদতকে আরও সুন্দর এবং কার্যকরী করে তোলে।
৮. মূর্খতার বিপদ
হযরত আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
জ্ঞানের অভাবে মানুষ বিপথে চলে যায়। (মুসলিম: ২৬৯৮)
এই হাদিসে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, জ্ঞানের অভাব মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে। যেসব মানুষ জ্ঞানার্জন থেকে বিমুখ থাকে, তারা মূর্খতার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নেয় এবং আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরে যায়।
৯. জ্ঞান চর্চা অব্যাহত রাখা
ইসলামে জ্ঞানার্জন এবং তা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন:
যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়াস চালায়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। (তিরমিজি: ২৬৪৬)
এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে যে জ্ঞানার্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মুসলমানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের পথে এগিয়ে দেন যারা সারাজীবন জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত থাকে।
উপসংহার
ইসলামের আলোকে দেখা যায়, শিক্ষা এবং জ্ঞানার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি ব্যক্তির ইহকাল এবং পরকালীন জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে। মহানবী (স.) এর হাদিসসমূহে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ তাআলা জ্ঞানীদের বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। যারা জ্ঞান অনুসন্ধান করেন এবং তা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেন, তারা কেবল দুনিয়াতেই নয়, আখিরাতেও সফলতা লাভ করবেন।